জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণ এবং আইআইটি খড়গপুর সংযোগ।
আমরা সকলেই জানি ২০২১-এর ২৫ ডিসেম্বর জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এরিয়েন ৫ লঞ্চ ভেহিকলের সাহায্যে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। এটি বিশ্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎক্ষেপণযানের মধ্যে একটি। এটিকে নির্ভরযোগ্যতার কারণে বেছে নেওয়া হয়েছিল কারণ, এটিই একমাত্র উয়ক্ষেপণ যান যেটি ওয়েবের মতো অভিযানে দরকারি নাসা-র সব ধরণের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে সক্ষম।
অনেকেই জানেন না যে ফ্রেঞ্চ গায়ানার ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ESA) স্পেসপোর্ট থেকে এই উৎক্ষেপণের সঙ্গে যুক্ত ছিল আইআইটি খড়্গপুর-ও।
আইআইটি খড়গপুরের প্রাক্তন ছাত্র ড. রণবীর সিনহা (B.Tech/Aero/1981) এরিয়েন ৫ নোজ কোন অ্যান্ড পেলোড ফেয়ারিং (পিএলএফ)- এর স্ট্রাকচারাল ডিজাইন এবং সিমুলেশন নিয়ে কাজ করেছেন, যা উৎক্ষেপণের সময় ওয়েবকে সুরক্ষিত রেখেছে।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি) হল একটি বৃহৎ মহাকাশ বিজ্ঞান মানমন্দির যেটি পদমর্যাদায় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ-এর পরেই রয়েছে। এটি মহাবিশ্বের অজানা অনেক সম্পদের উত্তর খোঁজার জন্য এবং এক-ই সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানে সাফল্য অর্জনের প্রয়োজনে নকশা করা হয়েছে। ওয়েব, ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি (ESA), দ্য ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NASA), এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (CSA) -এর মধ্যে এক আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের নজির, যেটিকে উৎস উদ্ঘাটনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল৷ এটি মহাবিশ্ব সৃষ্টিকালে তারা, গ্রহ এবং ছায়াপথের গঠনে নজর দিতে সমর্থ হয়।
এরিয়েন ৫-এ ১৭ মিটার লম্বা এবং ৫.৪ মিটার ব্যাসের পিএলএফ হালকা-ওজন কার্বন ফাইবার রিইনফোর্সড প্লাস্টিক (CFRP) এবং গ্লাস ফাইবার রিইনফোর্সড প্লাস্টিক (GFRP) স্যান্ডউইচ প্যানেল দিয়ে তৈরি যা অ্যালুমিনিয়াম অ্যালয় রিং এবং ম্যাগনেশিয়াম অ্যালয়ের উল্লম্ব সেপারেশন সিস্টেমের সঙ্গে একত্রিত করা হয়। ডাঃ সিনহার দায়িত্ব ছিল পেলোড বা লঞ্চারকে আঘাত না করে বিচ্ছেদ নিশ্চিত করা।
ডঃ রণবীর সিনহা একজন বিখ্যাত রকেট-বিজ্ঞানীই নন, তিনি একজন উদ্ভাবক এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। তিনি ভারতের আইআইটি-খড়গপুর থেকে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক প্রযুক্তি ডিগ্রি অর্জন করে স্নাতক শ্রেণিতে শীর্ষস্থানীয় যোগ্যতা-ও অর্জন করেছিলেন। তিনি তার এম.এস. এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পিএইচডি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটা, থেকে অর্জন করেন । তাঁর পিএইচ.ডি. থিসিস কম্পিউটার-এডেড মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইনের ক্ষেত্রে সফ্টওয়্যার ইন্টিগ্রেশনের প্রাথমিক শর্তগুলির একটি বলতে দ্বিধা নেই।
ডঃ সিনহা ইউরোপের মহাকাশ শিল্পে গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন এবং ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার অনেক প্রকল্পে অবদান রেখেছেন, যেমন-রোসেটা স্পেসক্রাফ্ট, মেটিও-স্যাট সেকেন্ড জেনারেশন, এটিভি-ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন ট্রান্সপোর্টেশন, ইউরোপীয় এরিয়ান-৫ রকেট ছাড়াও আমেরিকান অ্যাটলাস-ভি রকেট, ইত্যাদি। তাঁর অনেক উদ্ভাবন বিশ্বব্যাপী মহাকাশ শিল্পে আদর্শ অনুশীলনে পরিণত হয়েছে।
অ্যাটলাস-ভি রকেটের ওপর ডঃ সিনহার কাজ গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ২০১৩-এ স্থান পেয়েছিল।
ডঃ সিনহা বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের বাসীন্দা। তিনি একটি গবেষণা সংস্থার প্রধান-ও; এছাড়াও তিনি স্বেচ্ছায় ভারতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান ও অনুপ্রাণিত করছেন অবিরত। তিনি সোসাইটি ফর প্রমোটিং অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং এই সংস্থার পূর্বসভাপতিদের একজন-ও। উদ্ভাবনী প্রকৌশলের পাশাপাশি, তিনি সাফল্য অর্জনে প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক যোগাযোগ দক্ষতা বিকাশের পন্থাগুলিও ছাত্রছাত্রীদের শেখান। তিনি সর্বাধিক ফলদান নিশ্চিত করার প্রয়োজনে, বাস্তবসম্মত এবং অভীষ্ট শিক্ষার কৌশলগুলি ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দিতে যথেষ্ট যত্নবান হয়েছেন একসময়, অর্থাৎ চিরাচরিত পদ্ধতিতে ২০% সময়ের মধ্যে ৮০% সমস্যার সমাধান করেছেন তিনি।
গত তিন দশক ধরে, ডঃ সিনহা আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের জন্য অটোমেটেড ট্রান্সফার ভেহিকল, মেটিওস্যাট সেকেন্ড জেনারেশন, অ্যাটলাস ভি পেলোড ফেয়ারিং, এক্স-রে মাল্টি-মিরর টেলিস্কোপ- সহ অসংখ্য মহাকাশ কাঠামোর নকশা ও বিশ্লেষণের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।
ড. সিনহা বর্তমানে ব্যবহারিক প্রকৌশল শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির দিকে মনোনিবেশ করছেন। ACSESS এমনই একটি প্ল্যাটফর্ম যার মাধ্যমে তিনি এবং তাঁর দল ভারতের ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে আদান-প্রদানের পেশাদার দক্ষতা বিকাশে সাহায্য করেন।
তিনি সুইজারল্যান্ডের সিনহা রিসার্চ ইনস্টিটিউটেরও প্রধান।
ডক্টর সিনহা বলেন,ছাত্র হিসেবে তিনি যে ব্যবহারিক সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করেছেন তা তাঁকে তাঁর কর্মজীবনে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। তিনি আইআইটি খড়গপুরে তাঁর এনসিসি এয়ারউইংয়ের দিনগুলিকে স্মরণ করে বলেন এই শিক্ষা কেবল তাঁর মধ্যে শৃঙ্খলা, আত্মবিশ্বাস, দলগত কাজ, নেতৃত্বদানের ক্ষমতা অর্জনেই সাহায্য করেনি, এটি তাঁর ব্যক্তিত্ব বিকাশেও অনেকাংশে সাহায্য করেছে।
ডঃ সিনহা ভারতের মহাকাশ শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী। ইসরোর বাইরেও, তিনি বেসরকারি মহাকাশ সংস্থাগুলির বাণিজ্যিক বিকাশে সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন।
ভারতের তরুণ ছাত্রদের প্রতি তার বার্তায়, ড. সিনহা বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষণ এবং একাধিক দক্ষতা বিকাশের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, কেবল শিক্ষাই ন যথেষ্ট নয়, শিক্ষাকে অবশ্যই প্রয়োগ অনুসন্ধানে সাহায্য করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সমাধানে রূপান্তরিত করতে হবে। তিনি এছাড়াও সামাজিক সংযোগ গড়ে তোলার দক্ষতা অর্জনে যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দেন।
পরিশেষে তিনি তরুণ প্রজন্মকে আমাদের মহান সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে ভুলে না যাওয়ার পরামর্শ দেন।
Post a Comment